কেন বারবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা
একাত্তর সাল। পশ্চিম পাকিস্তানিদের থাবা থেকে নিজেদের মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পাওয়ার জন্য এ দেশের দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। নিয়েছিল গেরিলা ট্রেনিং। ঘরের প্রিয়জনদের মায়া-মমতাকে তুচ্ছ করে শত্রুকে মোকাবিলা করতে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন আধপেট খেয়ে কখনো বা না খেয়ে বন জঙ্গলে কাটিয়েছেন। নয় মাস যুদ্ধ করার পর পেয়েছিলেন লাল-সবুজের একটি পতাকা। বাংলাদেশ নামে একটি দেশ উপহার দিয়েছিলেন তাঁরা।
সেই সোনার ছেলেরা কি তখন কিছু পাওয়ার আশায় যুদ্ধে গিয়েছিলেন? যাননি। তাঁরা গিয়েছিলেন নিজেদের একটি পরিচয়ের জন্য। আমাদের একটি মানচিত্র থাকবে, শুধু সেই আশায় গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর সেই বীর ছেলেদের দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে, যার যার দক্ষতা আর বীরত্বের মাপকাঠিতে।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাঁদের। সম্মান দিয়েছে জাতি। সেই তালিকায় হয়তো অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়েছিলেন। পরবর্তীতে কারো নাম সংযুক্ত হয়েছিল। কেউ বা রয়ে গেছেন তালিকার বাইরেই। কারণ এমন অজপাড়াগাঁয়ে হয়তো তিনি থাকেন, শহরের অনেক খবর সেখানে পৌছেনা।
সবচেয়ে অবাক লাগে, যখন শোনা যায় প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসার পরই নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার ধুম পড়ে যায়। সরকার তাদের দলের লোকজনদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য অপতৎপরতা চালায়। দেখা যাকে তালিকাভুক্ত করা হলো সে মুক্তিযুদ্ধেই যায়নি। কিংবা তখন তার বয়স ছিল দশ কি বারো। কখনো আবার আগের সরকারের আমলে করে যাওয়া তালিকা থেকে অনেককেই বাদ দেওয়া হয় শুধু বিরোধিতা করার জন্য। এভাবে দেশে একেকবার সরকার পরিবর্তন হয় আর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়তে থাকে, আবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বাদ পড়ে যায়।
স্বাধীনতার পরে এখন পর্যন্ত ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা ও মানদণ্ড দশবার পাল্টানো হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে এখন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ৩২ হাজার। নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যুক্ত করার জন্য এখন পর্যন্ত এক লাখ সুপারিশ পেয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। গত ২১ জানুয়ারি প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শুরু হয়।
এখন জনমনে প্রশ্ন আসতেই পারে, কারা যাচাই-বাছাই করে এই নতুন নাম পাঠাল? মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার স্থানীয় সাংসদদের নেতৃত্বে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়েছে। তাঁরাই তাঁদের পছন্দমতো নামের সুপারিশ করেছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে কোনো কোনো এলাকায় মন্ত্রী ও সাংসদদের প্রভাব খাটানোর বিষয়টি। সবচেয়ে অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হচ্ছে, অর্থের বিনিময়েও তালিকাভুক্তির জন্য নাম পাঠানো হয়েছে। কোথাও কোথাও এমনও হয়েছে, স্থানীয় সাংসদ ঢাকায় থাকেন, কিন্তু তাঁর পছন্দের একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁর জেলা বা উপজেলার নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পাঠানোর জন্য। এখানেই শেষ না, সেই পছন্দের ব্যক্তিটিও ঢাকায় থাকেন এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কেন এই নাম ওঠানোর প্রতিযোগিতা? কিসের লোভে? এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মুনতাসীর মামুন যথার্থই বলেছেন, ‘সরকার যদি এখন ঘোষণা দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে না, তা হলে কাল থেকে কেউ আর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তুলতে চাইবেন না।’
তিনি আরো বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কেন এই সুবিধা পাবেন? এসব বন্ধ করা উচিত। আর কোনো তালিকা করা উচিত হবে না।
মুনতাসীর মামুন মনে করেন, এখন যা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থেই হচ্ছে।
আমাদের এই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বাড়ানো বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে কোনো কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে বাদ দেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ কবে হবে? কেন যাচাই-বাছাই কমিটিকে পাঁচ কোটি টাকা সম্মানী ও খরচ দেওয়া হবে? জানা গেছে, এবার যে সাংসদদের নেতৃত্বে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়েছে, তাদের জন্য এই পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এই টাকা কার? জনগণেরই তো, নাকি?
মহান ত্যাগের বিনিময়ে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পেয়েছেন বা পাননি, আমরা তাঁদের আর অপমান করতে চাই না। তাঁদের দোহাই দিয়ে যাঁরা নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন, বাড়ি-গাড়ি করছেন, তাঁদের জানাই ধিক্কার। তাঁদের লজ্জা থাকা উচিত, এখনো এই বাংলাদেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা বয়সের ভারে কাবু হয়ে গেছেন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিয়ে কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। আর আপনারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেরই জন্মই হয়তো হয়নি, বা মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগকে বোঝার মতো বোধশক্তিই হয়নি, তাঁরা এই বিশাল কাজ করে সরকারি টাকা নিচ্ছেন, তাঁদের একটু লজ্জা থাকা উচিত।
সবশেষে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মহলকে বলব, মুক্তিযুদ্ধের মতো পবিত্র বিষয়টিকে নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা যাতে না হয়, সেদিক নজর রাখা দরকার।
Comments
Post a Comment